স্বচক্ষে দেখিলাম যাহা বিলাতে/ তারা সবাই বাস করে এক ভালোবাসার জগতে…।
তাঁকে আর নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মতো কিছু নেই! ভাটির পুরুষ শাহ আবদুল করিম সকলের প্রিয় করিম ভাই। ১৯৬৮ সালে তাঁর প্রথম বিলেত ভ্রমণ; সফরসঙ্গী ছিলেন সিলেটের আরেক লোককবি দুরবীণ শাহ। তাদের গানের ঘোরে বেশ কিছুদিন মাতোয়ারা ছিলেন বিলেতবাসী।
লন্ডনের ক্যামডেন এলাকার সুরত মিয়ার বাসায় একরাতে জমে ওঠে করিম-দূরবীণ শাহ দ্বৈরথ। ভোররাত অবধি চলে আসর আর সেই আসরে উপস্থিত ছিলেন সৈয়দ জুরন আলী (৭৮)। সেই আনন্দময় স্মৃতি হাতড়িয়ে বললেন, ভক্ত-শ্রোতাদের জায়গা সংকুলান হচ্ছিল না, আবার কেউ যেতেও চাইছিলেন না। দেশের বাইরে সেই সময়ে এমন সরস গানের আসর আর লোকগানের দুই দিকপালকে কাছে পাওয়াও ছিল বড় ব্যাপার।
১৯৮৫ সালে দ্বিতীয়বারের মতো বিলেত দর্শন করে করিম লিখেছিলেন বিলাতের স্মৃতি। অল্পদিন বিলেত থেকে সেখানকার মানুষের যাপিত জীবনের নিখুঁত চিত্র তুলে ধরেন সুদীর্ঘ গানে। শাহ আবদুল করিম বলেছেন,
‘উনিশশো পঁচাশি সনে বিলাত থেকে কয়েকজনে
হঠাৎ ভাবিলেন মনে সিলেটের শিল্পী আনতে।
শিষ্য মোর রুহি ঠাকুর, কাজি আয়েশা, শফিকুন নুর
হাফিজ উদ্দিন বড় চতুর যোগ দিবে সে তবলাতে।’
সেই সফরে শিষ্যদের নিয়ে বিলেতের নানা শহরে গান করেছেন করিম। কিছু অনুষ্ঠানের ভিডিওচিত্র এখনো ইউটিউব চ্যানেলে দেখতে পাওয়া যায়।
২০০৭ সালে পুত্র নুর জালালকে সঙ্গে নিয়ে করিমের শেষ বিলেত ভ্রমণ। তবে সাক্ষাৎ করিমের দেখা পাননি তখন বিলেতবাসী। সুযোগ হয়নি প্রিয় মানুষের সঙ্গে কথা বলার। লন্ডনে পৌঁছেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। লন্ডনে বেশ কিছু দিন চিকিৎসাধীন থেকে দেশে ফেরেন করিম।
২০০৯ সালে শাহ আবদুল করিমের সাহায্যার্থে লন্ডনে আয়োজন করা হয়েছিল চ্যারিটি গানের অনুষ্ঠান। ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর সহযোগিতায় আয়োজকদের মাঝে অন্যতম ছিলেন বিলেতের পরিচিত শিল্পী রওশন আরা মণি। অনুষ্ঠান আয়োজকেরা করিমের পরিবারকে প্রায় দশ লাখ টাকা দিয়েছিলেন বলে জানা যায়।
দেশে কিংবা ভিনদেশে বাংলা ভাষাভাষীর মানুষের সাংস্কৃতিক আয়োজনের অন্যতম আকর্ষণ থাকে করিমের গান। বিলেতে তাঁর অগণিত ভালোবাসার মানুষের আবাস। যারা নিয়ত তাঁর গানের বন্দনা করেন। বিলেতে করিম বন্দনার কিছু টুকরো গল্প দিয়েই তাঁর স্মৃতি তর্পণ।
১৯৮৮ সালে বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যার সময় বিলেতে সফরে আসলেন সিলেটের বেশ কজন শিল্পী। সেই শিল্পী দলে ছিলেন বিলেতের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী গৌরী চৌধুরী। তার কাছ থেকেই শোনা যাক। গৌরী চৌধুরী বললেন, বিলেতের নানা শহরে আমরা গান করেছি। শাহ আবদুল করিম তখন খুব একটা পরিচিত ছিলেন না। তবে আমি তাঁর ‘আমি কুল হারা কলঙ্কিনী, আমারে কেউ ছুঁইয়ো নাগো সজনী’ গানটি করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়াই।
২৪ মে ১৯৯৮, বিলেতের খ্যাতনামা উম্বলি কনফারেন্স হলে আয়োজন করা হয়েছিল বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসব। বাংলাদেশ থেকে আসা তারকা শিল্পীদের দলে ছিলেন হুমায়ূন আহমেদের হিমু খ্যাত অভিনেতা ফজলুল কবির তুহিন। আয়োজকদের মাঝে অন্যতম একজন ছানু মিয়া। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বললেন, উম্বলি কনফারেন্স হল ও ম্যানচেস্টারের অ্যাপোলো মিলনায়তনে আমরা দুটি শো করেছিলাম। শুধুমাত্র শাহ আবদুল করিমের গান গাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম ফজলুল কবির তুহিনকে। হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত জলসাগর অনুষ্ঠানে তুহিনের সুর ও কণ্ঠে গাওয়া করিমের ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ গানটি তখন তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
কাকতালীয় ব্যাপার! ২৫ বছর আগে যে অনুষ্ঠানের কথা জানতে ফোন করলাম ফজলুল কবির তুহিনকে। আর তিনি তখন সিলেটে শাহ আবদুল করিম জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠানে ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ গানটি শেষ করে মঞ্চ থেকে নামলেন মাত্র। তুহিন বললেন, করিমের গান গাইতেই আমার প্রথম বিলেত আসা হয়েছিল। উম্বলির মতো বড় মঞ্চে গান গাওয়া আর দর্শকদের ব্যাপক সমর্থন প্রেরণা জুগিয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের জলসাগরে গানটি গাইতে পারা ছিল বড় ব্যাপার। আজকে শাহ করিমের জন্মশতবর্ষে গান করতে পেরে খুবই গর্বিত।
২০০২ সালে একতার মিউজিক থেকে বের হয় জনপ্রিয় শিল্পী হাবিবের সংগীতে বিলেত প্রবাসী কায়ার গানের অ্যালবাম কৃষ্ণ। বাংলা লোকসংগীত নিয়ে হাবিবের ভিন্ন ধাঁচের সংগীত আয়োজন অ্যালবামটিকে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে দেয়। দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে নতুন আঙ্গিকে করিমের গান। পরের বছর হাবিবের সংগীতায়োজনে একতার থেকেই বের হয় মায়া। অ্যালবামে গান করেন আরেক বিলেতপ্রবাসী শিল্পী হেলাল। কথা হয় করিমের গান গেয়ে খ্যাতি পাওয়া শিল্পী কায়ার সঙ্গে। কায়া জানান, করিমের গান গেয়েই আমার পরিচিতি, আমার সৌভাগ্য তাঁর গান প্রচারের এমন সুযোগ পেয়েছি। বাংলা লোকসংগীতের প্রবাদ পুরুষ শাহ আবদুল করিম। তাঁর গানই তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে।
২০১০ সালের জুনের প্রথম সপ্তাহে সিং আপ, সিং আউট শিরোনামে বিলেতের নিউহ্যাম এলাকার ২৮টি স্কুলের ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ৭৫০ জন খুদে শিক্ষার্থী গাইল শাহ আবদুল করিমের গান ‘গাড়ি চলে না, চলে নারে!’ সেই সন্ধ্যায় উপস্থিত থাকায় উপভোগ করেছিলাম করিমের গান পরিবেশনের এক বিশাল চিত্র। লন্ডনের অভিজাত রয়াল ফেস্টিভ্যাল হলে করিমের গানটি পরিবেশনের সুযোগটি তৈরি করেছেন প্রজেক্টের এশিয়ান মিউজিক প্রশিক্ষক শিল্পী গৌরী চৌধুরী। শিশু-কিশোরদের পরিবেশন পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় প্রজেক্টের কো-অর্ডিনেটর জেইন হুইলার্সের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কেনো তারা করিমের গান বেছে নিলেন?জবাবে জেইন জানিয়েছিলেন, আমাদের স্কুলগুলোতে নানা দেশ থেকে আসা বাচ্চারা পড়াশোনা করে। অভিনব অজানা কিছুর দিকেই ওদের আগ্রহ বেশি। শাহ আবদুল করিমের গান, জীবন দর্শন সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত অবহিত হয়েছি গৌরী চৌধুরীর কাছ থেকে। আর নানা পর্যালোচনার মাধ্যমেই এই গুণী শিল্পীর গাড়ি চলে না গানটি জুড়ি বোর্ড মনোনীত করে। ২৮টি স্কুলের ৭৫০ জন শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি প্রতিটি স্কুলের সংগীত প্রশিক্ষকদেরও তাঁর সম্পর্কে জানতে হয়েছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা জানার সুযোগ পেয়েছে সুদূর বাংলাদেশের এক বিখ্যাত লোককবির কথা।
১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯ লোকান্তরিত হন ভাটি বাংলার অযত্ন লালিত শালুক, গণমানুষের কবি শাহ আবদুল করিম। তাঁর মৃত্যুর তিন দিন পর বিলেতে আসি। ০৪ অক্টোবর পূর্ব লন্ডনের ব্র্যাডি আর্ট সেন্টারে বৈশাখী মেলা ট্রাস্ট ইউকে আয়োজন করে তাঁর স্মরণসভা। আয়োজকদের পক্ষ থেকে সেদিন জানানো হয় বিলেত প্রবাসীদের অর্থে সিলেটে নির্মিত হবে শাহ আবদুল করিম ইনস্টিটিউট। প্রথম আলোতে সেই খবর লিখেও ছিলাম। যদিও উদ্যোগের কোনো অগ্রগতি আর জানা যায়নি।
৩ আগস্ট ২০১৪ যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড শহরে সেলিব্রেশন অব ব্রিটিশ বাংলাদেশি কালচার সংগঠনটি আয়োজন করে দুই দিনব্যাপী শাহ আবদুল করিম উৎসব। আয়োজনে যুক্ত ছিল করিমের গানের অন্তপ্রাণ ভক্ত পেরুতে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর বিদায় সংবর্ধনা। করিমের গানের প্রতিযোগিতায় সেরা শিল্পী হিসেবে ১০ হাজার পাউন্ড জিতে নেন প্রবাসী বাউল শহীদ। শাহ আবদুল করিমের গান নিয়ে মাতোয়ারা আনোয়ার চৌধুরীর কথা কমবেশি অনেকেরই জানা। সেই অনুষ্ঠানেই কথা হয়েছিল তার সঙ্গে। করিমের গান নিয়ে তিনি বললেন, তাঁরে আমি খুঁজে ফিরি। আমাদের দেখা হয়নি ব্যাপারটা বাকি জীবন পীড়ার কারণ হয়ে থাকবে। করিমের গান আমাকে ভালোবাসায় দোলায়, আমার আমাদের শিকড়ের কথা বলে। শাহ করিম আমাদের অনেক দিয়েছেন আর আমরা তাঁকে যোগ্য সম্মানটুকুও দিতে পারিনি; সেটাই আফসোস।
একই বছরের শেষ দিকে বিলেতে আসে করিমের জীবন ও দর্শন নিয়ে মঞ্চনাটক মহাজনের নাও। শাকুর মজিদ রচিত ও সুদীপ চক্রবর্তী নির্দেশিত ঢাকার সুবচন নাট্য সংসদের আলোচিত মঞ্চ প্রযোজনা। পূর্ব লন্ডনের ব্র্যাডি আর্ট সেন্টার কানায় কানায় পূর্ণ। পরপর দুটি সন্ধ্যা হলভর্তি মানুষের উপস্থিতি জানান দেয় বিলেতে করিম-প্রিয়তা। নাট্য মুহূর্তের বাইরেও সকলের প্রিয় করিম ভাই, ভালোবাসার মানুষ। সালেহা বেগমের (৫৪) নীরব কান্না, নাটক দেখে বলছিলেন, কেমন নাড়িছেঁড়া টান অনুভব করছিলাম। আমার বাপের বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলায়, তাঁর গানের সঙ্গে ভাব অনেক দিনের। এ দেশে বেড়ে ওঠা আমার ছেলেও তাঁর গান শোনে। এমন নিখাদ সরল মানুষ আর হবে না। এটি শুধু নাটক নয়; শাহ আবদুল করিমকে স্মরণের অনন্য প্রয়াস।
সুবচনের দলপতি গিয়াস আহম্মাদ প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, মনে হয়নি ভিনদেশে আমরা নাটক করছি। পৃথিবীজুড়ে করিমের ভক্তকুল। শত ব্যস্ততার মাঝে মানুষের উপস্থিতি নজরকাড়া। অনেক দর্শক দাঁড়িয়ে নাটক দেখেছেন আর সেটি বাউল করিমের জন্যই।
বিলেতে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের শিল্পী শাপলা শালিকের গায়কিতে করিমের মন মজালে ওরে বাউলা গান দারুণ দর্শক-প্রিয়তা পেয়েছে। আর লাখো মানুষের মিলনমেলা লন্ডন বৈশাখী মেলা জমে ওঠে না করিমের গান ছাড়া।
বিলেতে এ সময়ের প্রতিশ্রুতিশীল কণ্ঠশিল্পী অমিত দে সব সময়ই ব্যস্ত গান নিয়ে। কখনো বাদক কিংবা গায়ক তবে দুই ক্ষেত্রেই সমান জনপ্রিয় অমিত। তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জানালেন, করিমের গান ছাড়া বিলেতে খুব কমই গানের অনুষ্ঠান শেষ হয়। ভিন্ন আমেজের আয়োজন হলেও করিমের ভক্তকুল শুনতে চান করিমের গান।
বিলেতে করিমের অগণিত ভালোবাসার মানুষের দেশ। বিলাতের স্মৃতি গানের শেষ প্যারায় তিনি বলেছেন,
বাউল আবদুল করিম বলে সৎ এবং সরল হলে
ভবিষ্যতে শান্তি মিলে পরশ মিলে লোহাতে।
জ্ঞানের কমল যদি ফোটে আলো আসে আঁধার টুটে
বিরাজ করে প্রতি ঘটে যারে খোঁজে জগতে।